My Attitude!

My Attitude!

Pages

My Blog List

Meet and Recognise-- I, Me and MySelf...!

@@@ ~WELCOME TO MY CYBER WORLD~ @@@











~~~ I am My Own Music, People Want to Get in Touch With Me... Play Your Lyrics By My Rhythm ~~~



Thursday, October 27, 2016

বিশ্বাসের ভাইরাস অনেক ছড়িয়েছে ... এবার সময় অ্যান্টিডোটের .

আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল আমার নতুন স্কুলে । প্রায় দু'বছর আগে আমার পুরোনো স্কুলেও একই কান্ড ঘটিয়েছিলাম । আজ আবারও । সেই একই ক্লাশ এইটে । কো-এড বা সহশিক্ষা স্কুল আমাদের ।
                                                                             

সেকেন্ড পিরিয়ড শুরু । ইংলিশ । পড়াতে পড়াতে ব্যাখ্যা দিতে দিতে নানা গল্পের অবতারনা করা আমার স্বভাব । তো আজও ইংলিশ টেক্সট এর একটা বিষয় আলোচনা করতে করতে আগের সিলেবাসের পাঠ্য Pandora's Box গল্প টেনে আনলাম । যারা জানে না তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, গল্পটি এইরকম --


                             " সে অনেক কাল আগের কথা । পৃথিবীতে তখন কোনও দুঃখ , কষ্ট , যন্ত্রনা ছিল না। সবাই খুব আনন্দে থাকত । মানুষের মধ্যে কোনও ঝগড়া-হিংসা-দ্বেষ ছিল না । সকলে আনন্দে একসাথে সুখেই বাস করত । মোট কথা পৃথিবী একটা রূপকথার দেশ ছিল । সেই সোনাঝরা দিনে ঈশ্বর / GOD দুজন ছোট ছেলে মেয়েকে ধরাধামে পাঠালেন । ছেলেটির নাম এপিমিথিউস এবং মেয়েটির নাম প্যান্ডোরা । তাদের বয়স ১২- ১৪ বছর । প্যান্ডোরা হল সবচেয়ে ছোট । তাদের সাথে পাঠালেন একটি সুন্দর লোভনীয় বাক্স । বাক্সের কিন্তু কোনো তালা ছিল না । শুধু একটি সুন্দর কারুকার্য করা ঢাকনা ছিল । বাক্সটি পাঠানোর সময় গড আদেশ দিয়েছিলেন বাক্সটি কখনো যেন তারা না খোলে । যদি খোলে তাহলে পৃথিবীতে প্রলয় আসবে । তো এই ছোট দুই বন্ধু গডের আদেশকে শিরোধার্য করে বাক্স নিয়ে পৃথিবীর বাড়িতে এল । বয়সে ছোট বলে প্যান্ডোরার খুব ইচ্ছে ছিল বাক্সটির মধ্যে কি আছে তা জানতে । এপিমিথিউসও যে অনাগ্রহী ছিল, তা নয় । সেও সমান আগ্রহী ছিল বাক্সের রহস্যভেদে । কিন্তু ওই গডের আদেশ...কিভাবে তা তারা লঙ্ঘন করে ! তাই এপিমিথিউস নিজের ইচ্ছেকে চেপে প্যান্ডোরাকে বারবার সাবধান করতে লাগে যেন কোনোদিন ভুলেও বাক্স না খোলা হয় , নইলে পৃথিবীতে গডের অভিসম্পাত নেমে আসবে । প্যান্ডোরা মেনে নিলেও বারবার সে ভাবে হয়তো বাক্সে সুন্দর কোনো খাবার আছে ,বা খেলনা আছে বা পোষাক আছে বা নানা রকমারি দ্রব্য আছে । কিন্তু সাহস করে কিছুতেই বাক্সের ঢাকনা সে খুলতে পারে না । এদিকে বাক্সের তালা-না থাকা আর তার উপরে সুন্দর সুন্দর মুখের ছবি, ফুল-লতাপাতার ছবি ইত্যাদি দেখে প্যান্ডোরা ভীষন আকর্ষণ অনুভব করে বাক্স খোলার জন্য । কিন্তু ওই গডের আদেশ আর এপিমিথিউসের কড়া নির্দেশ ... এই করে করে একদিন হঠাৎ বাক্স থেকে সে কিছু আওয়াজ শুনতে পায় ।
কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে, 'আমাকে বের কর প্যান্ডোরা । ' আমাদের মুক্তি দাও প্যান্ডোরা '
--- এই আওয়াজে প্যান্ডরা দিশেহারা হয়ে  বাক্সের ঢাকনা সরিয়ে ফেলতে উদ্যোত হল । আর তো কৌতুহল চেপে রাখা যায় না । ঠিক সেই মুহুর্তে এপিমিথিউস দরজার আড়াল থেকে মেয়েটির কাণ্ড দেখতে লাগল কিন্তু যেহেতু সে নিজেও বেশ কৌতুহলি ছিল তাই সে প্যান্ডোরাকে বারন করতে বা আটকাতে পারল না । এদিকে বাক্স খোলার সাথে সাথেই সারা পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল , তার সাথে বাক্স থেকে কী যেন সব বেরিয়ে এপিমিথিউসকে কামড়ে দিল । সে যন্ত্রনায় ছটফট করে উঠল " প্যান্ডোরা তুমি একি করলে । আমায় কে যেন কামড়ে দিল । প্রচন্ড ব্যাথা করছে।" 
প্যান্ডোরা দিশেহারা । সে বুঝতে পারল এক বিশাল ভুল সে করে ফেলেছে । সঙ্গে সঙ্গে সে বাক্স বন্ধ করল এবং আবার ঘরে আলো এল । এবার সে এপিমিথিউসের দিকে চাইল ও দেখল সে বিষে নীল হয়ে গেছে ।
           এর পর পরেই সে বাক্স থেকে আরেকটা আওয়াজ শুনল " আমায় বের কর প্যান্ডোরা । আমি তোমাদের শান্তি দেব । আমায় বিশ্বাস কর ।" অনেকটা অবিশ্বাস নিয়েই প্যান্ডোরা আবার বাক্সটি খুলল । এবার তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক সুন্দর পরি । সে তার জাদুদণ্ড দিয়ে এপিমিথিউসের ক্ষতস্থানে বুলিয়ে দিল ও তার সব যন্ত্রনার অবসান ঘটল । এরপর পরিটি তার পরিচয় দিয়ে বলল, "আমি আশা ( Hope ) . তুমি এর আগে বাক্স খুলে যেসব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনাদের পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছ, আমি সেগুলোকে সহ্য করার ক্ষমতা দেব । আমায় মনে করেই তোমরা এদুনিয়ার সব দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে ।এই বলে আশা বা Hope পৃথিবীর বুকে উড়ে চলে গেল । তবে থেকে আমরা সব দুঃখ কষ্ট গুলো আশার আলোয় ভুলে থাকতে চেষ্টা করি ।"


------------- গল্পটি বলার পরে দেখলাম আমার স্টুডেন্টরা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে ।
এবার শুরু হল প্রশ্নত্তর পর্ব ।
আমি --- " আচ্ছা গল্পটা থেকে কি বুঝলে ? দোষটা কার ছিল ?
ওরা --- " প্যান্ডোরার,  মিস ।"
--- "কেন ?"
--- "ওই তো সব দুঃখদের ছড়িয়ে দিল সারা দুনিয়ায় ।"
--- "আচ্ছা বেশ । এবার বলতো, বাক্সটি পাঠিয়েছিল কে ?"
--- "গড ।"
--- " হুম । আচ্ছা , একটু অন্যভাবে উদাহরন দিই । ধর, তুমি বা তোমরা মামাবাড়ি গেছ । সেখানে গিয়ে খুব মজা করছ । সেই মামাবাড়িতে তোমার মামি বা অন্যকেউ তোমায় একটা টিফিন বক্স দিয়ে বল্লেন 'আমি না বলা অব্ধি এই ঢাকনা কিন্তু খুলবে না ।'  তো তোমাদের কি একবারো মনে হবে না কী আছে ওই টিফিন বাক্সে ? চকলেট ? মিস্টি নাকি দারুণ একটা মোবাইল ফোন ! কী এমন সারপ্রাইজ ? মনে হবে না , সত্যি করে বলোতো ?"
---- "হ্যাঁ মিস । মনে তো হবেই । " একজন আবার বলল, "আমি তো খুলেই ফেলব মামী যাওয়ার সাথে সাথেই ।"

---- "আচ্ছা । তাহলে বলতো এরম মনে হওয়াটা কি পাপ ? অন্যায় ? প্যান্ডরা তো তোমাদেরই বয়সি মেয়ে । বন্ধু বলা যায় । তাই না ?"
---- "হ্যাঁ মিস । এরম তো মনে হতেই পারে ।"
--- "তাও দেখ ও কিন্তু লোভে পড়ে বাক্স খোলে নি । ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষায় ছিল গডের আদেশের। কিন্তু ওই বক্সে যখন নানা রকম আওয়াজ বেরোতে শুরু করল তখন সে আর পারল না । তোমরা কি পারতে চুপ থাকতে ?"
---" না নাআআআআআআ ...মিস ।"

--- " ওকে । তো দেখ, যিনি বাক্সটা পাঠালেন তিনি যদি জানতেনই যে এটা দুঃখের বাক্স , তাহলে কেন পাঠালেন ? আর যদি তিনি পাঠালেনই তাহলে তালা দিলেন না কেন ? একটু ভাবো , তার মানে কি এটা নয় যে পৃথিবীর সুখ শান্তি যাতে নষ্ট হয় তার জন্য গড অনেক আগেই একটি কন্সপিরেসি বা ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং সেটা যাতে ওনার নিজের হাতে না ঘটে একজন মেয়ের দ্বারা ঘটে সেই মত তিনি প্ল্যান করেই এই দুই শিশুকে তার অশুভ খেলায় ঘূঁটি বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন । তাই না কি ?"

---- " হুম মিস । এটা তো একদম ঠিক ।" অনেকে চুপ থাকলেও বেশ কিছু জন এরম বলল ।
      "কিন্তু মিস, গড তো ভালো । উনি তো আমাদের মঙ্গলের জন্যই সব করেন , তাই তো জানি । ...কিন্তু  ...  এটা কিরম হল ...... " ওরা যে বেশ চিন্তিত এটা বোঝাই যাচ্ছিল । 


---- " বেশ , এবার দেখ , গড কিন্তু জানতেন মানুষের কৌতুহল অপরিসীম । আবার তোমরা নিশ্চয় নানা পূজা-পার্বনে- বাড়িতে -ধর্মের গল্পে জেনেছ যে গড বা ঈশ্বরের আদেশ ছাড়া নাকি পৃথিবীতে একটা গাছের পাতাও নড়ে না । তো এখানে দেখ, তাঁর ইচ্ছেতেই ওই দুজন দুনিয়ায় এল ।  তাঁর ইচ্ছেতেই বাক্স এল তালা ছাড়া, লোভনীয় সব কারুকাজ সহ । তাঁর ইচ্ছেতেই প্যান্ডরা ও এপিমিথিউস দুজনের মনেই অদম্য কৌতুহল এল বাক্সের রহস্য উদ্ধারে । তাঁর ইচ্ছেতেই বাক্সের ভেতর থেকে নানা আওয়াজ বেরুতে লাগল এবং তাঁর ইচ্ছেতেই শেষমেশ বাক্সটি খুলল প্যান্ডরা এবং কষ্টগুলো পৃথিবীতে মুক্তি পেল । এখানে প্যান্ডোরা তো জাস্ট একটা খেলার ঘূঁটি --- তাহলে বলতো প্যান্ডরা কি আদৌ দায়ী এই কাজে ?"

--- " নাআআআআআআআআআ নাআআআআআআ ।"
---- " তাহলে কে প্রধান দোষী এই সমস্ত অপকাজে ? একটু ভেবে নিজের মত করে বল দেখি ।"

--- "গড" । পেছনের বেঞ্চ থেকে উত্তর এলো । বাকিরা পিছন ফিরল এবং এর পরে সকলে সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল  " প্যান্ডোরা নয় , গড দায়ী ।"

---- " তাহলে বলোতো  আমাদের মধ্যে যদি কেউ বিভেদ লাগানোর চেষ্টা করে, আমাদের মনকে বিচলিত করে তাকে কি আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ ?"

-----" নাআআআআআ মিস ।" একসাথে ৪৫ জন চেঁচালো ।

--- "তাহলে এই সামান্য গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম, আমাদের কাকে বিশ্বাস করা উচিৎ না ?"

একটু কনফিউজট দেখালেও কেউ কেউ সাহস করে বলল " গডকে !"

--- " কীসের ভয় ? যা মনে হচ্ছে বল । "
--- "গডকে, মিস  । ঈশ্বরকে , মিস । ভগবানকে মিস । আল্লাহ কেও মিস ।" সারা ক্লাশে যে যাকে উপাসনা করে তার নাম ধরে উত্তর দিতে লাগল ।

---- " ওকে । আচ্ছা এবার বলতো , তাহলে কাকে বিশ্বাস করে আমরা ঠকব না ? দেখি কে বলতে পারে ?" হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করি ।
কারুর মুখে কথা নেই । সবাই ভাবছে । কাকে ? কাকে ? কাকে ??

ঘড়ী দেখলাম , পিরিয়ড শেষ হতে চলেছে । ছোট্ট একটা চক নিয়ে বোর্ডে লিখলাম ' GOD ?'

 ---- "না মিস, গডকে নয় ।"

--- "আচ্ছা , এবার দেখ তো । " বলে Word টাকে উল্টে লিখলাম ' DOG .' কী? ... ডগ মানে জানো তো ? একে বিশ্বাস করা যায় তো ?

---- হ্যাঁআআআআআআ হ্যাঁআআআআআআ ... ... সারা ক্লাশ ফেটে পড়ছে ৪৫ জনের কোরাসে ।

"মিস, আরো বলুন  । আরো একটা গল্প । প্লিজ ... " 

ঘন্টা পড়ে গেল । ঢং ঢং চাপা পড়ে গেল ওদের মিলিত কণ্ঠস্বরে । আমার আজকের মিশন সাকসেসফুল, বেশ বোঝা গেল ।
ক্লাশ থেকে বোরোনোর আগে বললাম, 'নিশ্চয়, আরো অনেক কিছু বলব তোমাদের ।'
--- "কবে, মিস ?''
---'' আজ নয় , পরে ।''

বেরিয়ে এলাম ক্লাশ থেকে ।বাইরে থেকে শোনা গেল ওদের হাততালি । কী ভীষন এক জগদ্দল ধারণা আজ একটু হলেও নড়েছে । এটা জানি না ওরা কতটা অনুভব করল, আমি করলাম ।

--------------------------         --------------------------    -----------------------------------------------------------   ------------------------------------------------

**************     আমি কি একটু একটু করে পপুলার হচ্ছি ? কে জানে ?
পপুলারিটি পাওয়া আমার লক্ষ্য নয় , ছিলও না কখোনো । একজন শিক্ষিকা হিসেবে আমি ওদের মনের সংকীর্ণতাগুলোকে নাড়াতে, সরাতে চাইছিলাম । ওদের শিশু মনের কোমল অথচ ভীষন ছোঁয়াচে বিভ্রান্তিগুলোকে সারাতে চেয়েছি মাত্র ।

  কাগজে দেখছি কিভাবে মাদ্রাসাগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের ব্রেন ওয়াশ হচ্ছে ঈশ্বর প্রেমের প্রতি । অবিশ্বাসীদের কোতল করার প্রতি কিভাবে আকর্ষিত করা হচ্ছে তাদের । নাস্তিকদের লাশ ফেলে দেওয়াকে 'ঈমান পাওয়ার ' এক অভ্রান্ত পথ হিসেবে শুধু বর্ণনাই করা হচ্ছে না , রীতিমত ট্রেনিং দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১২-১৩ বছর বা তারো কম বয়সেই ।

'বিশ্বাসের ভাইরাস' এভাবে কিছু শিক্ষক নামধারী  পিশাচের মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় । তারা বই ফেলে বোমা বাঁধছে সারা দুনিয়া জুড়ে । শান্তির ধর্মের নামে অশান্তি , সন্ত্রাস এর বীজ বপন করছে । রক্ত স্রোত বইছে বিশ্ব জুড়ে । একটা অসম অঘোষিত যুদ্ধে কেবল সাধারন মানুষের প্রান যাচ্ছে । ওরা একে ডাকছে 'শক থেরাপী' নামে ।


আমি ,মোমমিছিলে হাঁটতে, শোকসভায় মাথানত দাঁড়াতে বিশ্বাসী নই । তাই আর কিছু পারি না পারি , নাহয় এই অসম যুদ্ধে  আরেকটা 'শক থেরাপী' সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারি তো । একটা অ্যাণ্টিডোট বানাতে পারি তো । হয়তো এটা এমন কিছুই নয় । একা এইভাবে সাড়া জাগানোর কিছুই হবে না হয়তো , তবু দিনের পর দিন যদি এমন ভাবে পুঁথিগত বিদ্যের বাইরে কিছু অবিশ্বাসী তৈরীর চেষ্টা করি... ক্ষতি কি?

 ক্ষতি যা হওয়ার সেতো হচ্ছেই দিন দিন । মানুষ প্রতিদিন অন্ধ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে , নাহয় একটু হাত বাড়ালাম ওই ছোট ছোট শিশুদের মনটাকে অন্ধকার থেকে টেনে তোলার জন্য । ওরা ভাবুক , চিন্তা করুক, প্রশ্ন করুক , চিৎকার করুক, প্রতিবাদ করুক ।


জানি , আমরা থাকব না সেই আলোকিত প্রভাতে যেদিন হয়তো এরা আরো কিছু মানুষকে ঠিক এই ভাবেই একটা গল্প বলবে । একটু অন্য আঙ্গিকে একটু অন্য দৃষ্টীভংগীতে । সেদিন আমি মরেও শান্তি পাব ।


ইউটোপিয়া ?? না হয়, তাই । 


'বাঙালি জাতি' বনাম আমরা - ওরা'

উৎসবের মরশুম । এ সময় বাঙালির উদারতা বা সর্বজনীনতা যার পরনাই বেড়ে যায় । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ কণ্ঠস্বরমাখা যে ভোর বাঙালির ঘরে ঘরে নষ্টালজিয়া এনে দেয় , তা কারুর কাছে শারদীয়ার বিনা ঠিকানার চিঠি , আবার কারুর কাছে ভোরের আজানের মত মিস্টি । একটা কথা আজকাল বেশ প্রচলিত “ ধর্ম যার যার , উৎসব সবার।“ এই আপ্তবাক্যই ভারতের বিশেষত বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাবাহক । তবু , মণ্ডপের ভিড়ে কান পাতলে আজও শনা যায় , “ এই দ্যাখ তোদের দূর্গাকে জুম করে ক্যাপচার করলাম । তোরা কি আমাদের আল্লাকে ধরতে পারবি !” অথবা
“ এটা তো তোদেরই রেওয়াজ রে , তুই জানিস না ! আমাদের মধ্যে তো এ খাবারের চল নেই ।“
অর্থাৎ সবেতেই প্রচ্ছন্ন একটা আমরা – ওরার সূক্ষ্ম স্রোত । সাহিত্যিক আব্দুল জব্বার বলেছিলেন “ গোঁড়ারা ধর্মের ঢেঁকি । ... পুরোনো গর্তের ইঁদুর। নতুনকে নিতে পারে না । “
কথাটা শুধু যে ছাপ মারা  ‘গোঁড়া’দের সঙ্গেই বসে , তা না । আমাদের সঙ্গেও একশ ভাগ যায় । সামাজিকতা বজায় রাখতে সুগার কোটেড স্পিচ যতই দিক , নিজের ‘আসল’টা কিন্তু কেউ ছাড়ে না । ‘আসল’ মানে ‘Identity ‘ – নিজের জন্ম- পারিবারিক জাত-ধর্ম-স্বজাতের শিক্ষা ।
আর এই যার যার / তার তার আইডেন্টিটিই বাঙালির বাঙালিয়ানার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা । যা কখনোই আমাদের হিন্দু-মুসলিম আইডেন্টিটির বাইরে স্রেফ ‘বাঙালি’ পরিচয়ের একমাত্র সুতোয় বাঁধতে দেয় না ।
আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু অভিজ্ঞতা নিশ্চয় হয়েছে , কিন্তু স্ব-স্ব সংস্কার বশত এগুলোকে আমরা ‘স্বাভাবিক’ বলেই মেনে নিয়েছি ।

'দিন আগের কথা ।পাড়ার এক ব্যক্তির সাথে প্রায়ই দেখা হয়, কথা হয় টুকটাক । কিন্তু কখনও দেখি সে বাংলায় কথা বলছে, কখনও দেখি হিন্দিতে । আমার সাথে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে , তো সেদিন বইয়ের দোকানে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আপনি বাঙালি তো ?”
জবাব পেলাম, " না, আমি মুসলিম ।"
একইসাথে আমি অবাক ও চিন্তিত । চিন্তিত এইজন্য যে, উনি কি আমার প্রশ্ন বুঝতে পারেন নি, নাকি জানেন না । অবাক এইজন্য যে, আমি তো ধর্ম পরিচয় জানতে চাই নি, তাহলে অযাচিত উত্তর দেন কেন !

----"না, আমি জানতে চাইছি আপনি মুসলিম হলেও বাঙালি তো!"
---" আরে, না না । বাঙালি হব কেন? আমি তো মুসলিম ।"
---"তাহলে আপনার মাতৃভাষা কি ?"
---- "বাংলা ।"
এবার আমি বুঝলাম । এরম ঘটনা এই প্রথম নয় । আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। রাস্তাঘাটে অচেনাদের বাদই রাখলাম, চেনা পরিচিতদের থেকেও এমন ঝটকা খেয়েছি আগে

মনে পড়ে, গত বছর একটি ছেলে, আমাদের গ্রুপের কমন বন্ধু হিসাবে প্রায় একমাস ধরে ফোন, SMS ইত্যাদিতে বেশ সাবলীল ভাবে কথাবার্তার পরে জানতে চেয়েছিল ,আমি ‘বাঙালি’ কিনা ! তো আমি 'হ্যাঁ' বলেছিলাম ।পরে আমার পুরো নাম শুনে বলেছিল,
---- "ও! তাহলে তো তুমি মুসলিম ? বাঙালি বললে কেন ? "
--- "কারন, ওটাই আমার আসল পরিচয় । পদবীটা তো জন্মসুত্রে পাওয়া আর ধর্মটাও তাই ।"
---"ও , কিন্তু তাহলে বল বাঙালি মুসলিম । বাঙালি নও । বাঙালি মানে তো আমরা, হিন্দুরা ।"

এবার আমি চমকে যাই । প্রচন্ড অপমান ও রাগে বলেছিলাম,
----- " মানেটা কী ? 'জন হিন্দুকে দেখাতে পারবে, যে আমার চেয়ে বেশী বাঙালি ? ধর্ম পরিচয়টাই আসল হল ? "

আসল ব্যাপারটা হল, 'বাঙালি' শব্দটা এরাজ্যের হিন্দুরা বহু ব্যবহারে নিজেদের জাত-ধর্মের সাথে এমন ট্যাগিয়ে নিয়েছে যে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যে বাঙালি হতে পারে, তা একরকম ভুলেই গেছে বা মানতে চায় না ।

এরপরে ট্রেনেও কথা বার্তায় দেখেছি, আমার পাশে বসা বোরখা পরিহিত মুসলিম মেয়ের সাথে জিন্স টী-শার্টের মুসলিম মেয়ের কথা হচ্ছে হিন্দীতে । দুজনেই বন্ধু বা পরিচিতসম্ভবত ঝাড়খন্ডী নন-বেংলী ।
---- " রোজা কা টাইম আ গায়া । ফির ঈদ হ্যায় । মার্কেটিং হো গ্যায়া ক্যায়া তেরা ?"
----- " হাঁ ইয়ার । অর বোল মাত , সালোয়ার শিলহানে দিয়ে তো শালে নে চুস্ত বানা দিয়া । বোলা কি , আব ইহি ফ্যাশান হ্যায় । ওয় বাংগালী লোগ বোলতে হ্যায় না, চুড়ি-পাজামা !"
---- হাহাহাহা !
----- "সহি হ্যায় ইয়ার । বঙ্গালি মুসালমান লোগ ভি না এইসাহি কাপড়া বানাতে হ্যায় । "
---"আরে ছোড় না , উহ লোক ভি মুসলিম হ্যায় ক্যা !"
--- " সাহি বোলা ইয়ার । বাংগালি লোগ মুসলিম বিরাদারি কা গিনতি মে নেহি আঁতে ।"
---" এক্সাক্টলি ইয়ারবঙ্গালি মুসলিম লোগোকা না জাত হ্যায় না ধরম । ওভি হিন্দু হি হ্যায় ।"

এই দু-চারটে আম বাতচিতেই প্রমানিত 'বাঙালি' শব্দটার কি নির্মমভাবে বলাৎকার হয়েছে ।
না, এর জন্য ওই দেশভাগ, আর শ্রেনী বিভক্ত সমাজের ঐতিহাসিক বহু চটকানোতত্ত্ব বা তার ভুক্তাবশেষকে দায়ী করেই কিন্তু আমরা নিজেদের মানে, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের স্বশিক্ষা বনাম সুশিক্ষার দায় কোনওভাবেই এড়াতে পারি না ।
অনেক প্রগতিশীল উচ্চশিক্ষিত কর্পোরেট ওয়ার্কার হিন্দু বন্ধুদের দেখেছি, যারা সোশাল মিডিয়ায় নানা কথার ফুলঝুড়ি সাজায়, সমাজের নানা উচ্চ বর্গিয় ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসা করে, নানা সমাজ সেবা মূলক কাজও করে । কিন্তু যখন বিদেশি বন্ধুদের সাথে আলাপ পরিচয় করে, তখন এইভাবে ভারতীয় কালচারের উদাহরণ দেয়,
---" ইটস দা টাইম অফ দূর্গাপূজা । উই আর নাও প্রিপেয়ারিং ফর আওয়ারকালারফুল ফেস্টভাল অফ ওয়ারশিপিং গডেস দূর্গা । দেন কামস কালী পূজা । ইউসী, বেংলীস আর ভেরি কালারফুল পিপল । উই বেংলীস সেলিব্রেট ভেরিয়াস পূজাস, দোলপূর্নীমা অর হোলি উইথ কালারস ।...ইন আওয়ার কালচার ম্যারেজ ইস আলসো ভেরি কালারফুল । বেংগলী ম্যারেজেস আর ডান উইথ ফ্লাওয়ারস এন্ড সিন্দুর ; দ্যাটস অলসো আ ডাস্টিরেড কালার । বেংগলী উইমেন্স উইয়ার হোয়াইট শাড়ি উইথ রেড বর্ডার ইন মেনিফেস্টিভ্যাল অর সেলিব্রেশনস , লাইক বিজয়া দশমী হুইচ ইস দ্যা এন্ড অফদূর্গা পূজা ......"

কথা চলতেই থাকে ফোনে, চ্যাটে , নেটে, ডেটে, স্কাইপে তে । সেইবিদেশি ব্যক্তিটি কতখানি 'বাঙালি কালচার' বুঝল , কে জানে । কিন্তু কথার আড়ালে থেকে যায় চাপা একটা অজ্ঞতা , অজ্ঞানতা , কুশিক্ষার বীজ ।

'বাঙালি কালচারেঠাঁই পায় দূর্গাপূজা, হোলি, হিন্দু বিবাহ, সিঁদুর ইত্যাদি । বাদ যায় নবান্ন, বইমেলা, নববর্ষ, বসন্ত উৎসব ,একান্ত বাঙালিদের মেতে ওঠার দিন ২১শে ফেব্রুয়ারীর রঙ্গিন উজ্জ্বলতা ।

যে পরিচয়টা ভাষা ভিত্তিক হওয়া উচিৎ, তা আজ একটি নির্দিষ্ট ধর্মের একচেটিয়া প্রপার্টি বলে বদনাম কুড়াচ্ছে । যে পরিচয় ধর্ম-জাত ,শ্রেনী-বর্ণ,নারী-পুরুষ , উচ্চ-নীচ, পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি মোটা দাগের গন্ডীকে একলহমায় দূর করতে পারে, তা নিজেই আজ একটি ‘বিশেষ জাতি’র পরিচয় বাহক
এটা 'বাঙালি' শব্দের অপমান, বাঙালি সমাজের লজ্জা, গোটা জাতির গ্লানী ।
এই যে বাঙালি কালচারে 'আমরা' / 'ওরা' ভাগ , এটা কিন্তু সমাজের মজ্জাগত  
থেকে তাবৎ প্রগতিশীল , সুশীল , শিক্ষিত সম্প্রদায়ও মুক্ত হতে পারে নি এটা শুধু যে 'সহি মুসলিম' প্রজাতির সাথে 'সনাতন হিন্দু' প্রজাতির দ্বন্দ্ব তা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে
এসব কট্টর তকমাধারিদের বাইরেও যে একসমুদ্র সাধারণ মানুষ আছে যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে এমন বিদ্বেষ-ঘৃনা-হিংসাত্মক চিন্তাভাবনা
হ্যাঁ, সবটাই কিন্তু অভিজ্ঞতা লব্ধ নয়, বেশিরভাগই শ্রুতিলব্ধ ' জ্ঞান '
শিক্ষিত প্রজন্ম উদারতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি নিয়ে লেকচার দিতে শিখেছে ঠিকই , কিন্তু তা জীবনে বাস্তবায়নের সময় ভুলে যায়, সম্প্রদায়-জাত-ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে মানুষ জন্মায় না একটা নাম একটা পদবী দিয়ে এসব জাতিগত ট্যাগ আমাদের গায়ে জোর করে বসানো হয় তারপর সেই বেমক্কা জন্মে পড়া মানুষ সেই নামের চক্করে, বংশানুক্রমিক পরম্পরার ধারা বজায় রাখতে রাখতে কেমন করে যেন 'হোমো-স্যাপিয়েন্স' নামক আসল প্রজাতিটার স্বীকৃতি অস্বীকার করে  
তখনই গড়ে ওঠে স্ব স্ব সারনেম ধারী 'সারমেয়' গোষ্ঠী এবং সমান তালে চলে ভিন্ন গোষ্ঠীর থেকে নিজেদের জাত অহংকার কতটা বেশি তা তুলে ধরার মরিয়া চেষ্টা ...ভৌ ভৌ ভৈরবে আদপে মানুষের মধ্যে বিভেদটা কিন্তু Preoccupied mind এর ফসল আমরা নিজ নিজ ওরিজিন আঁকড়ে রাখার চক্করে একটা সত্যি কথা ভুলে যাই ,  চেহারায় 'মানুষের' পালিশটা ধরে রাখতে পারলেই একটা জীবন ঠিকই বেঁচে-বর্তে থাকা যায়  
তাকে খামোকা হিঁদু- মুসল্লির ফেসপ্যাক দিয়ে মোড়াটা অর্থহীন
হাজার নয় লাখ নয় ...একটা তো মাত্র জীবন তাই না !

আমার রাজ্যের সকল উদারমনষ্ক ‘বাঙালি’ দের কাছে জানতে চাইছি,  একবারও কি নিজেদের সন্তানদের ২১শে ফেব্রুয়ারীর গল্প শুনিয়েছেন ?
শুনিয়েছেন, যে একটা জাতি শুধুমাত্র তাদের মাতৃভাষা চর্চার অধিকারের জন্য হাসতে হাসতে বারুদের সামনে বুক চিতিয়েছিল ? তারা তখন দেখেনি কোন ধর্মের লোক তার সাথে হাত মিলিয়েছে তারা শুধু হাতগুলোকে আঁকড়ে ধরে মুষ্টিবদ্ধ করতে জেনেছিল । সেই হাতগুলো , প্রানশক্তিগুলোই তাদের কাছেই বড় ছিল, ধর্মপরিচয়গুলো নয় কিন্তু ।

হে বাঙালি , সত্যি যদি সেই গল্প শুনিয়ে থাক তোমাদের আত্মজদের , তবে নিশ্চিত জেন, তারা আর যাই হোক সগর্বে নিজেদের হিন্দু- মুসলিম বলার আগে 'বাঙালি' বলতে শিখবে । বাঙালি কোন ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুত্বের পরে তাকে জিজ্ঞেস করবে না "তুমি বাঙালি হিন্দু ,নাকি বাঙালি মুসলিম?"

আর যদি না শুনিয়ে থাক নিজেদের জাতির ভাষাগত সংঘর্ষের কথা, তবে নিজেকে গর্বিত 'বাঙালি' বলে পরিচয় দেবার আগে, বিদেশি বন্ধুকে 'বাঙালি কালচার' বোঝানোর আগে এটাই পরিস্কার জেনে রেখ, তোমাদের মানবজন্ম হয়তো হয়ে গেছে, কিন্তু 'বাঙালি'  হওয়া এখনো ঢের বাকি