তাঁকে আমরা ভালোবাসি বা
না বাসি, সমর্থন করি বা না করি, তবু তাঁকে ঘিরে চায়ের কাপে আজও ঝড় ওঠে সে
মধ্যবিত্তের তলতলে জীবনযাপনেই হোক বা তাবর রাজনীতিবিদের টেবিল ঠোকা বৈঠকি বিকেলেই
হোক । তাঁর ক’টা বই বেরল বা ব্যান হল, কেমন আছেন তিনি , কোথায় কাটছে তাঁর জীবন
সেটা জানি বা না জানি, তবু আজো তাঁকে নিয়ে কম লেখালিখি কিন্তু হয় না । প্রিন্ট
মিডিয়ায় কথা বলছি না, সোসাল সাইট গুলোর ‘ভার্চুয়াল পাঠশালার’ কথাই বলছি । সে যাই
হোক আজ এতখানি পথ পেরিয়ে এসবে তাঁর কিছু যায় আসে না ।
হ্যাঁ আমাদের যায় আসে ।
আমরা মানে গুটিকয় সচেতন
আর কোটি কোটি অচেতন বা অর্ধচেতন পাব্লিক যারা কাগজে তাঁর নাম দেখলে গোগ্রাসে সেটি
পড়ে, মিডিয়ার দেওয়া গালভরা গাল ‘বিতর্কিত লেখিকা’ শিরোনাম পড়ে চুক চুক আওয়াজ তোলে
জিভ-টাগরায় এবং অবশ্যই চায়ের কাপে ।
তারপর একদল বলে : ‘কি লাভ এসব বিতর্কে জড়িয়ে ? এখানে কি আছে খালি ব্যান ,নয়
বিতর্ক ! বরং সুইডেনে উনি নাগরিকত্ব নিয়ে স্বচ্ছন্দে বাস করলেই পারেন ।‘
একদল বলে: ’ কি আর করবে
সংসার তো পেল না, বই আর বিতর্ক লিখেই এবং গাল খেয়েই দিন কাটে । ঘরের খেয়ে বনের মোষ
তাড়ানো আর কাকে বলে ! যত্তসব !”
একদল যোগ করে : ‘ জীবনে ধর্ম মানে না । মেয়েমানুষ হয়ে অত ঠোঁট কাটা হলে চলে
? ওর পাপ লাগবে না তো কি আমাদের লাগবে ? এত জিভ-ছোলা কথা বললে ধর্মে সইবে নাকি !
এখনো সময় আছে তোওবা করে ধর্মের পথে আসুক। নিজের ঘরে ফিরতে পারবে । নইলে আজীবন
নির্বাসন ঘুচবে না। দেশ থেকে ও আপদ আমরা তাড়িয়েই ছাড়ব ।’
আর একদল ‘প্রগতিশীল’ হাঁ
হাঁ করে তেড়ে এসে বলে : ‘কেন? এদেশে যদি
আজমল কাসভের মত ইন্টারন্যাশানাল জংগি , আফতাব আন্সারির মত ন্যাশানাল জংগি, কোটি
কোটি চোর পলিটিশিয়ান এবং আমাদের এত শত বিতর্কিত বুদ্ধিজীবি থাকতে পারে, তবে তসলিমা
কেন নয় ?’
অবাক হই । যেন তসলিমার থাকার
সাথে দাগানো খুনি-জংগির নামগুলোই একমাত্র উদাহরণ ! নেগেটিভিটির মাঝে যে মানুষটা
পজেটিভ ভাইব ছড়ানোর জন্য প্রাণপাত করছেন ,অন্ধকারের মাঝে থেকেও যিনি সত্যের টর্চ
হাতছাড়া করেননি এক মুহুর্তও, তার সাথে কেবল অন্ধকার জগতের লোকের তুলোনা হচ্ছে !!
আমার মনে আছে , স্কুলে
পড়া বয়সে ক্লাশ এইট হবে, সম্ভবত ১৯৯৯, এক বন্যার সময়ে বাবার বইয়ের আলমারী থেকে
হাতে পড়েছিল ‘নির্বাচিত কলাম’ এবং ‘লজ্জা’ ।আগে তুলে নিয়েছিলাম ‘নির্বাচিত কলাম’
বইটি । পড়তে শুরু করেছিলাম শুয়ে শুয়ে এক দুপুরবেলা আর পাঁচটা গল্পের বই পড়ার মত,
ভাত ঘুম দেওয়ার আগে। বেশ মনে আছে বইটা যখন শেষ করেছিলাম রাত তখন ৮ টা এবং আমি সোজা
হয়ে উঠে বসে পড়েছিলাম, নিজেরও অজান্তে। ঘুমের ঘোরেও দু’চোখের পাতা অনেক দেরিতে এক
হয়েছিল । ‘লজ্জা’ ওই বয়সে পড়ে কিছুই বুঝি নি । কোন ইতিহাসের কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে
লেখা জানতাম না, পড়ার বইয়ের বাইরে খবরের কাগজের সাথে আলাপ ছিল না । বইগুলো লুকিয়ে
পড়েছিলাম বাবার বকার ভয়ে , সেই শুরু লুকিয়ে পড়ার, লুকিয়ে লেখার এবং অনেক কিছু
লুকানো থেকে বের করে আনার । পরে মেয়েবেলার শেষ লগ্নে গিয়ে এবং বড়বেলায় এখনো দেখি
তাঁর নামের সাথে ‘লুকানো’ শব্দটিও এমনি এঁটুলির মত সেঁটে আছে যে আনন্দবাজারে
পত্রিকায় তাঁর ইন্টারভিউও বেরোল ‘তুই নিষিদ্ধ,তুই কথা কইসনা’ শিরোনামে । তবে হ্যাঁ
সেদিনের ওই লুকিয়ে তসলিমা পড়ার জন্যই হোক আর যাই হোক মেরুদন্ডটা বড্ড ঋজু হয়ে গেছে
।
তাঁকে নিয়ে আলাপ চারিতায়
মূলত যে যে ‘নিষিদ্ধ পয়েন্ট’ ট্যাবু আকারে বেরিয়ে আসে তা হল :
১। তসলিমার লেখাগুলো সাহিত্য
পদবাচ্য নয়: আমার এক বাংলা অনার্স বান্ধবী বলেছিল ‘ওকে আমি সাহিত্যিকের
পর্যায়ে ফেলিই না । ওর লেখায় রগরগে ব্যাপার বেশি, স্নিগ্ধতা নেই একদম।‘
আমি বলি, ‘হ্যাঁ রে ,
বাংলা সাহিত্য পদবাচ্য লেখা মানেই কি কাল্পনিক মিথ্যার আশ্রয়ে কিছু হিরো- হিরোইনের
কাহিনী থাকতে হবে ? যেখানে প্রেমঘন সেক্সদৃশ্য বর্ননা করার সময় মিষ্টি মিষ্টি কথার
আড়ালে নায়কের মুখে লেখক লিখবেন ‘কই,আমার সাদা পায়রা দুটো কই । তারা যে আমার হাতে
আদর খাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, আমি জানি। কাছে এস...‘ –আর সেটা পড়ে ‘নাজুক নাজুক’
বলে পাঠকের অন্তর্বাস ভিজে যাবে গোপন কামে । তবু সেটা সুন্দর । কারন সে গল্পের ঢাল
আছে “এই গল্পের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই । বাস্তবের কোন ঘটনা-স্থান-পাত্রের
সাথে যদি কোনও মিল পান তা নিছক কাকতালীয়!”
না, তসলিমার কলম এসব ঢাল
নিয়ে চলতে রাজী না । কারন উনি যা লেখেন তা আমার-তোমার জীবন থেকে সেঁচে নেওয়া বিষয়
। জীবনাদর্শ নিয়ে যা বলেন সেই জীবন উনি যাপন করেন । আর বাংলা সাহিত্যের কোন
বিশ্বকোষে লেখা আছে ‘ সাহিত্যের সাথে মিথ্যে কষ্ট কল্পনার নিরব আঁতাত থাকতেই হবে
?’ এমন কোন সংজ্ঞা আছে যে, সাহিত্যিকের সত্য বলা নিষিদ্ধ ?লেখক যে জীবন কাটান আর
যে জীবন লেখেন তার মাঝে থাকতে হবে যোজন দূরত্ব ? আছে যদি, তবে আমায় দেখাও ।
২। তসলিমা মেয়েদের জন্য
লেখে ভালো কথা , কিন্তু বড্ড বেশি ধর্ম-বিদ্বেষী : আমি বলি, ‘ধর্ম
মানবো আবার নারীমুক্তি / নারীর অধিকার নিয়ে গলাও ফাটাবো’ সেটা যদি চাও তাহলে আমায়
সোনার পাথরবাটি এনে দেখাও ! কারন ও দুটো তো একসাথে চলতে পারে না, এটা তো মেয়েরা
জীবন দিয়ে প্রমান করেছে যুগে যুগে । ওরা বলে , ‘প্রকৃত ধর্ম তো এরম না, মানুষ এমন
বানিয়েছে । ধর্মকে corrupt করেছে ।
--“ ও মা ! তাহলে ধর্মও
যে politician
দের মত রং চেঞ্জ করে corrupt হতে পারে তা স্বীকার করছ তো, ধর্মও তাহলে কাঁচের বাটিতে
রাখা জল, যাকে যখন খুশি ধর্ম ব্যাবসায়ীরা ব্যাবহার করে, কুলকুচি করে, কফ থুথু দেয়,
আবার গংগা জলের মত পূজাও করে ! এর চেয়ে কি নাস্তিকতা ভাল না ?’
৩। তসলিমা পুরুষ বিদ্বেষী
: আমায় কিছু জন
বলেছে, বেশি ওপেনলি ওঁর অনুগামী হতে যেও না। পুরুষ বিদ্বেষী তো তাই ওর অনুরাগী হলে আর এ জন্মে তোমার
বিয়ে হবে না ।
--কেন ?
-- তুমি জানো না, তসলিমার
লেখা মানতে গিয়ে কত কত সংসারে আগুন লেগেছে । কত সম্পর্ক ভেংগেও গেছে ওর জন্য ।
তাই কি ? কটা বই পড়েছে ওরা
তসলিমার, যারা দাবি করছে ও পুরুষ বিদ্বেষী / সংসার বিরোধী ? আসলে কিন্তু
সম্পর্কগুলো অন্য কারুর জন্য ভাংগে না, ভাংগে নিজেদের কারনেই । আর যদি অন্য কাউকে
দায়ি করার মত অবস্থা দাঁড়ায় তখন সেই সম্পর্কের ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে । সত্যকে
চেপে মিথ্যে দিয়ে সুখের বাড়ি নির্মান করা যায় না । পুরুষ-নারী সমতা যেখানে থাকবে
সেখানে সংসারে ফাটল ধরবে কি করে? এর জন্য পুরুষ বিদ্বেষী বা নারীপ্রেমীর প্রশ্ন
আসে কি করে!
এরম আরো অজস্র ট্যাবু
তৈরি আছে তসলিমার নামের সাথে । মিডিয়া এই সব ট্যাবুগুলোর ওপর ভর করেই খবর বানায় ।
তাই তাঁর কোন বই ব্যান হল তার খবর পেপারে ওঠে, তাঁর কোন বই বিদেশে বেষ্ট সেলার হল
তার খবর থাকে না । তাঁকে ঘিরে রাজনীতির নোংরা খেলার হলুদ সাংবাদিকতা হয়, যা চেপে
যায় তাঁর অক্সফোর্ডে লেকচার , জাতি-সংঘে বক্তৃতার, সান্মানিক ডিগ্রী প্রাপ্তি, ইউরোপিয়ান
পার্লামেন্টের তুমুল ক্লাশ - এরম আরো অজস্র উজ্জ্বল কৃতিত্বকে । কেন? এসব লিখলে কি
পেপারের কাটতি কম হবে? না, এসব লিখলে মোল্লাতন্ত্রের ধমক নানা রঙ্গের পার্টির
ওভারহেড ফোনের দ্বারা সংবাদপত্রের অফিসে আছাড়বে, যা আদপেই কোনো ‘নির্ভিক সাংবাদিক’
চাইবে না । তাই ছাপা হোক বিতর্কিত খবর, যদি উনি কিছু নাও বলেন তবু তাঁর মুখে বসানো
হোক এমন শব্দ , যা মানুষ এবং মোল্লা ‘খায় ভালো’ !
কিন্তু মুখে না বললেও
তসলিমার অতি বড় সমালোচকও এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন,সাহিত্যের আন্তর্জাতিক
বাজারে যে ক’টা মুষ্টিমেয় মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চাকারী আছেন , তসলিমা তাদের মধ্যে
বঙ্গ তথা বাংলা সাহিত্যের একমাত্র উজ্জ্বল প্রতিনিধি এবং বেষ্ট সেলার লেখক । তাঁর
লেখাকে আমরা যতই গালি দিই, লুকিয়ে পড়ি ,উপন্যাস-কবিতার পাতার পেঁয়াজ ছাড়াই, কখোনও
কাঁদি, কখোনও ‘ব্যান কর এ আবর্জ্জনা’ বলে ছুঁড়ে ফেলি না কেন বাংলা ভাষার একমাত্র
অভিবাসী লেখক হিসেবে আজকের প্রজন্ম তাঁকেই চেনে । হ্যাঁ শুধু তাঁকেই – যিনি
গোল্লাছুট খেলতে খেলতে কখন যেন নিজের অজান্তেই খেলা থেকে বাদ পড়েছেন , নির্বাসিত
হয়েছেন আমাদের জন্য আমাদের হয়ে আমাদের দাবীগুলো গুছিয়ে বলার জন্য আমাদেরই প্রানের
বাংলা থেকে । ‘সেই সব অন্ধকার’ আর ‘নেই, কিছু নেই’ এর মধ্যে বাঁচতে বাঁচতেও তিনি
স্বপ্ন দেখেছেন এমন এক সাম্যের সমাজ গঠনের যেখানে থাকবে না কোনো কাঁটাতার,
প্রতিষ্ঠা পাবে এক সুন্দর জাতি – ‘মানুষ’ যার নাম । আমরা তাঁকে সন্মান জানানো ত
দূরে থাক, প্রয়োজন বোধ করিনি কি লিখেছে তা পড়ে দেখার ।
সত্যি সেলুকাস, তাঁর জীবন এক বিচিত্র জার্নি ,
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে । আবার অনেক আলোকময় পৃথিবী প্রান্তের হাতছানি থাকা সত্বেও
যিনি ফিরে আস্তে চান সেই অন্ধকূপ পাঁকের জন্মভূমিতে, হাত বাড়াতে চান অজ্ঞানতায়
ডুবতে থাকা মানুষ গুলোর দিকে –তারা যাতে আলোর পথে আসতে পারে ।
তাঁর সত্যের পথ যদি আজ
রুদ্ধ হয়, সত্যি বলার জন্য যদি তাঁর নাম আজ ব্রাত্য হয় তবে বলতেই হয় : যদি তসলিমা ব্যান
হয় , তবে ব্যান হোক শিশুপাঠ্য হিসেবে আবশ্যিক নীতিপাঠ গুলোও:
·
‘ সদা সত্যং বদ ‘
·
‘ সকালে উঠিয়া আমি
মনে মনে বলি /সারা দিন আমি যেন সৎ পথে চলি ।‘
আমরা যাই করিনা কেন, কথা সেটা না, তিনি আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী ম্যাজিক ও
রিয়ালিটি । তাঁকে ধরে রাখতে না পারলে সেটা তাঁর অসন্মান নয়, কারণ তিনি সে সবের অনেক
উর্দ্ধে অবস্থিত, সেটা দেশের এবং জাতির কাছে লজ্জার । কারন , মূল্যবান রত্নের ছটা
নিয়ে অনেক তুফান তোলা বিতর্কসভা করা ছাড়া তার আসল মূল্য এই অভাগা অর্ধশিক্ষিত জাতি
কখনো কি দিতে পেরেছে ? তাই তো আমরা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠসময় নিয়ে বুলি কপচাই,
সোপ-অপেরা করি আর শ্রেষ্ঠ এক সৎ-সাহসী বাঙালি সাহিত্যিককে নির্বাসনে পাঠাই,
রাজনীতির নাটক করি ,আবার ঠুঁটো জগন্নাথের মত দেখিও ।
লেখাটা পড়ে আমার অন্তত ভালো লেগেছে। এই লেখায় সাহিত্যগত গুণ খুঁজতে যাওয়া উচিত নয় বলে আমার মনে হয়, কারন সেক্ষেত্রে তুলনা এসে যায়, যেটা আমি খুব একটা পছন্দ করি না। একেক জনের লেখার স্টাইল একেকরকম, তবে পড়ে যেটা ভালো লাগলো তা এই লেখার অধিকাংশ বক্তব্যই আমার চিন্তা ভাবনার সাথে মেলে। শুধু আমার কেন! অনেকেই হয়তো এই ধারণা পোষণ করেন। ওই অংশটা খুব ভালো লেগেছে "তসলিমার লেখাগুলো সাহিত্য পদবাচ্য নয়" শীর্ষক আলোচনা টা। আসলে কোনটা সাহিত্য আর কোনটা নয় এই ধারণটা কিন্তু সেই আদ্যি কালে থমকে নেই, সাহিত্যে অনেক অনেক বিবর্তন ঘটে গেছে। আমি মনে করি না সাহিত্যকে কোন বিশেষ ধরনের ছাঁচে ফেলা যায় বলে, আমার কাছে সবার যেটা গুরুত্ব পায় তা হল প্রথমত, কোন বিশেষ একটা লেখা আমার ভালো লাগছে কি না, দ্বিতীয়ত, সেই লেখায় লেখকের মৌলিকত্ব কতখানি? তৃতীয়ত, একটা লেখা মানব শরীরের মত, তারও মাথা হাত পা সব আছে, সেগুলো সঠিক ভাবে গঠিত হয়েছে কি না, চতুর্থত, লেখাটির অবস্থান কোথায়? অর্থাৎ সমসাময়িক যুগের থেকে পিছিয়ে আছে? সময়ের সাথে চলছে? নাকি বর্তমান সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে আছে... ইত্যাদি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে একটা ভালো লেখা। আমার যেটা খুব বেশী করে মনে হয় যে (এটা আমি তসলিমা দি কে টুইটারে বলেও ছিলাম) ওনার জীবনের এই যে এতো ঝড়ঝাপটা এতো উৎপাত, সে রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয় কিংবা কারুর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ অথবা ঈর্ষা, যাই হোক না কেন, এসব একটা কথাই বার বার প্রমান করে যে উনি সঠিক পথে চলেছেন, সত্যের পথে চলেছেন, কোন রকম আপস না করেই, আর এভাবে যারা চলে তাদের জীবনে এই সব যন্ত্রণা আসতে বাধ্য। এই পথে হাঁটলে তাদের দৃশ্যত একাই হাঁটতে হয় কারন মন জুগিয়ে বেশী দিন চলা যায় না। ধর্মের মধ্যে আছে টা কি ? বিভেদ আর কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই তো আমার চোখে পরে না, এর অন্ধকার দিক গুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরলে তারা তো ক্ষুণ্ণ হবেনই যারা এই অন্ধকার গুলো কে মূলধন করে অবলম্বন করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন। একটা খুব সাদা মাটা সহজ কথা হল এতকাল যাবত নারী বঞ্চিত হয়ে এসেছে এখনো হচ্ছে, এর ফলে পুরুষতন্ত্রের শিকড় এতো গভীরে প্রথিত হয়েছে যে তা ধরে যেই হ্যাঁচকা টান মারবে তাকে তো চক্ষুশূল হতেই হবে তাদের যারা বিশ্বাস করে নারী নিচু শ্রেণীর, পরিসংখ্যান গত ভাবে সংখ্যালঘু, অনুপাত গত ভাবে ৩৩। মেয়েদের জন্যে ৩৩% সংরক্ষণ এও পুরুষতন্ত্রেরই কথা বলে, ৫০%র কথা সবাই বলে না, কেন বলে না ? কোনও রাজনৈতিক নেতা নয়, ক্ষমতাসীন নেতারাও নয় কিংবা পাবলিকের লাথ খেয়ে বিতাড়িত কোনও রাজনৈতিক দলও নয়। প্রশ্নটা খুব সহজ নয় কি ? একটা বিস্কুট ভেঙে একটু বড় টুকরোটা যদি নিজের বোনকে, বান্ধবীকে, মাকে সহজেই দিতে পারি, তাহলে রাজনীতিতে কিংবা ক্ষমতাবিভাজনে এই তাগিদ কেন দেখতে পাব না ? কেন এতো কঠিন এই কাজ ? বেশী তো চাওয়া হয় নি ! চাওয়া হয়েছে তো সমান অংশ, এই প্রশ্ন যদি তুলি, আমি অপদার্থ প্রতিপন্ন হব, আর রে রে করে ছুটে আসবে সংবিধান, রাজনৈতিক তর্ক, পাতার পর পাতা অজুহাত স্তূপাকৃতি হয়ে যাবে এই ৫০%র বিরুদ্ধে। এই যে রাজনৈতিক ভাবে সঠিক থাকার প্রবণতা, এই যে মানসিকতা এ চিরকাল মানবতাকে, মানবিক তাগিদ কে চাপা দিয়ে এসেছে, উদাহরণ চাই ? তাহলে শুনুন, আমি একদা বিজেপি'র এক শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক নেতা কে একটু খুঁচিয়ে ছিলাম এই প্রসঙ্গ তুল যে তসলিমাদি কে কি ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না? যদিয় আমি তখন জানতাম না যে অন্য কোন দেশের নাগরিক হলে ভারতের নাগরিক হওয়া যায় কি না, সেই মুহূর্তে ওই রাজনৈতিক নেতা ক্রমাগত বলে গেলেন যে "তসলিমা নাসরিন কি ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন ? না!" এই অতিসঠিক যুক্তি আমাকে যতটা না রাগিয়েছে তাঁর থেকেও অনেক অনেক বেশী অবাক করেছে মানুষ হিসেবে, বাঙালী হিসেবে, দ্বিখণ্ডিতবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে, আমার কাছে এ শুধুই এক নীরস অমানবিক তার্কিকতা আর কিছুই নয়, অর্থাৎ ওই মুহূর্তে তাঁকে তার দল কে ডিফেন্ড করতে হবে, তসলিমাদির ভারতে থাকার বিষয়ের থেকেও অনেক অনেক বেশী তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই যে তসলিমা নাসরিন ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন কি না ! শুধু ভাবুন, আমার সম্মুখে যদি কোন বিপন্ন মানুষকে, ক্ষুধার্ত কোনও মানুষকে, ডুবন্ত কোনও মানুষকে দেখি, আমি কি সেই বিপন্নতার নীরব আর্তির সন্ধান করবো ? নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মানুষটাকে বাঁচানোর কথা ভাববো ? আমার কাছে বিপন্নতা বিপন্নতাই, তা সে খাবারের জন্যেই হোক বাঁ একটুকরো মাটির জন্যেই হোক, সে মানুষ হোক বাঁ একটা কাঠপিঁপড়ে কিংবা একটা পশু। ভারতের মাথারা কি একটু বোঝে না,এ ই যে তসলিমা নাসরিনের বার বার উপেক্ষিত হওয়া কত বড় লজ্জার আমাদের পক্ষে। আমি এ বিষয়ে আমি আরও কথা বলতে পারতাম কিন্তু প্রবৃত্তি হচ্ছে না। কারন বর্তমান রাজনীতিকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি, অবিশ্বাস করি। (১/২)
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো আপনার "তসলিমা পুরুষ বিদ্বেষী" এই অংশের আলোচনা টা। হয়তো আরও আলোচনার স্কোপ ছিল কিন্তু যেটুকু করেছেন ভালো লেগেছে আমার। একটা কথা আমার মনে হয় নারীবাদী মানেই কিন্তু পুরুষ বিদ্বেষী নয়। আর আমার কোনও দিনও তসলিমাদি কে পুরুষ বিদ্বেষী মনে হয়নি একটুও, একটুও না। পুরুষের অপকর্মের কথা যুক্তি দিয়ে মানুষের কাছে তুলেধরা কিন্তু পুরুষ বিদ্বেষ নয়, নারীর বঞ্চনার কথা বলা কখনই পুরুষ বিদ্বেষ নয়। নারীবাদের অন্তরাত্মা কে বোঝার চেষ্টা অনেকেই করে না শুধুই বাইরেটা দেখে, সেকারণেই পুরুষ বিদ্বেষ চোখে পরে। যা আদপেই সত্য নয়। কাপড় কাচতে গেলে যদি মুগুর দিয়ে মারতেই হয় তো মারতে হবে, না হলে ওই কাপড়ের নোংরা একদিন সমস্ত শরীরকে বিষিয়ে তুলবে। আমি হলফ করে বলতে পারি তসলিমাদি কে জানতে গেলে তাঁর মানসিকতা বুঝতে গেলে ওনার লেখা শুধু মাত্র একটা বই পড়লেই যথেষ্ট (সেটা যে কোন বই হতে পারে), কিন্তু যাদের মনে বিদ্বেষের ক্যানসার প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, দাসত্বের দাসখত ছেড়ে বেরনোর কোনই উপায় নেই, তাদের কাছে বিচার বিবেচনা, মানবিকতার আশা করাই বৃথা।(২/২)
ReplyDelete@Avijit Das অনেক ধন্যবাদ বন্ধু । হ্যাঁ আরো অনেক বিশ্লেষন বাকি থেকে গেল । আসলে উনি এমন এক জন মানুষ যাকে নিয়ে একটা প্রবন্ধে সব লেখা সম্ভব না । পরে আরো একটা প্লট সেটা মাথায় ড্রাফট আকারে ঘুরছে , ব্লগে দেব । রিপ্লাই পেয়ে খুব খুব ভাল লাগল ।
Deleteহ্যাঁ ! ঠিকই বলেছেন !
ReplyDeleteশুভেচ্ছা নেবেন আমারো !