গতকাল ভারতীয় উচ্চ আদালতের ঘোষিত একটি ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের গণতন্ত্রের উপর একচেটিয়া পুং মালিকানার মরচে একটু ঘষা খেল ।
একটি ব্যক্তিগত মামলার যুগান্তকারী রায়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল ভারতের গোটা নারী সমাজ ।
কি ঘটেছিল ?
এক অবিবাহিতা মহিলা গেজেটেড অফিসার নিজের সন্তানকে একলা মানুষ করার জন্য আদালতে যান , সন্তানের অভিভাবকত্ব চান । কিন্তু নিম্ন আদালত তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে, " অভিভাবকত্বের দাবী সম্বলিত পিটিশন দাখিলের ক্ষেত্রে বাচ্চার বাবার পরামর্শ আবশ্যক । "
ব্যাখা ছিল ' The guardians and wards Act ' এবং ' Hindu minority and guardianship Act' অনুযায়ী, অভিভাবকত্ব স্থানান্তর করতে গেলে বাবা-মা দুইয়ের অনুমতি লাগবে ।
কিন্তু মহিলা যুক্তি দিলেন , তিনি অবিবাহিত । বাচ্চার বাবার সাথে মাত্র দু'মাস কাটিয়েছেন । বাচ্চা যেমন বাবাকে চেনে না , বাবাও তেমনি বাচ্চার কথা জানে না । তাহলে কিসের অনুমতি?
এর পরেই তিনি গেলেন সুপ্রিম কোর্টে এবং গতকাল পেলেন এক ঐতিহাসিক জয় । যার সুফল কেবল তিনিই নন, ভবিষ্যতে পাবেন আরো অনেক নারী , যারা 'সিঙ্গল পেরেন্ট' হিসেবে দায়িত্ব নিতে সক্ষম এক কচিপ্রানের ।
রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত এবিষয়ে নিজেদের নোংরা নাক গলাতে ছাড়েন নি । কিন্তু তাদের যুক্তিও সুপ্রিম কোর্ট খন্ডন করেছে এই বলে , " বাবার পরিচয়ের দরকার নেই । সন্তান বেড়ে উঠবে মায়ের একক অভিভাবকত্বেই । "
নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের তীব্র সমালোচনা করেও উচ্চ আদালত জানিয়েছে, " শিশুর উন্নতির দিকটিই সবচেয়ে বেশী নজর দেওয়া উচিৎ ছিল । কিন্তু যে বাবা সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুলে যাওয়াকেই বেছে নিয়েছেন , তাকে সন্তানের ভালমন্দের শরিক নাই বা করা হল ।" এর সাথে এও জানিয়েছে,কোনো মহিলাকে সন্তানের পিতৃ পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য করা যাবে না । একজন আর্থিক -মানসিক সক্ষম মা তাঁর একক অভিভাবকত্বেই স্বাধীনভাবে সন্তানের প্রতিপালন করবেন ।
গত বুধবারও , এরমই আরো একটি যুগান্তকারী সাহসী রায় দিয়েছিল উচ্চ আদালত । বিচারপতি মিশ্র ও পন্থের বিভাগীয় বেঞ্চ একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেন , " ধর্ষনের শাস্তি কমিয়ে আনতে ক্ষতিপূরণ বা বিবাহের প্রতিশ্রুতি কোন ভাবেই গ্রাহ্য হতে পারে না । "
আর গতকাল যে রায় বেরোল , তাতে এটারই প্রতিধ্বনী শোনা গেল ," অবিবাহিত মায়েদের ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবক হতে আর বাধা রইল না । শিশুর বাবার পরিচয় এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয় ।"
সন্তানের কাস্টডী নিয়ে সমাজের নাক উঁচু-র পেছনে আছে দীর্ঘ পুরুষতন্ত্রের জং ধরা নারীবিদ্বেষী নিয়মকানুন এবং নারী স্বাধীনতা ও অধিকারকে দমিয়ে রাখার ইচ্ছে ।
ধর্ষনের বিচারে আজকাল প্রায়ই শোনা যায় 'মেয়ে নষ্ট ' হয়ে গেছে , পেটে বাচ্চা এসেছে । তাই একে বাঁচানোর একমাত্র পথ হল ধর্ষকের সাথেই বিয়ে দেওয়া । এতে মেয়েটির একটা 'বৈধ সামাজিক অভিভাবক' ও বাচ্চাটির একটি 'বৈধ পিতৃ পরিচয় ' জুটবে ।
ধর্ষন করবে পুরুষ , নষ্ট হবে মেয়ে ।
বাচ্চার জন্য বীর্য ঢালবে পুরুষ , নষ্ট হবে মেয়ে ।
বাচ্চা জন্মাবে সেই 'নষ্ট মেয়ে'র পেট থেকে , 'বাবা' হবে পুরুষ ।
আর মা যদি সেই বাচ্চা একা রাখতে চায় , ধর্ষককেই বিয়ে করতে বাধ্য করবে পুরুষতন্ত্র ।
পৃথিবীর যাবতীয় ভোগ-সুখ- অধিকার-নাম -ক্ষমতা - পরিচয়ের একচেটিয়া মালিক পুরুষ । অথচ তার মালিকানা ফলাতে দরকার একটি নারী দেহ-মন-আত্মা । পুং মালিকানায় পুরুষ প্রভুটি যখন খুশি দাসী নারীটিকে যা খুশি নামে ডাকবে , তার পরিচয় দেবে । আর সমাজ সেটাকেই মান্যতা দেবে ।
এই চলে আসছিল ।
এখন ঘটল এক উলোট পুরাণ ।
অথচ এটা ঘটার কথা ছিল অনেক আগে , অন্তত এক দশক আগে তো বটেই । কারণ 'সিঙ্গল পেরেন্টশিপের' দাবী আজকের নয় । কয়েক দশক ধরে মেয়েদের যোগ্যতা ও সাহসিকতার ন্যায্য দাবী এটি ।
একটি মহিলা যখন আর্থিক ভাবে , মানসিকভাবে প্রস্তুত ও সক্ষম , সন্তান ধারণ ও ভরণপোষনের , তখন সমাজ কে তাকে বাধা দেবার ?
আসলে, সমাজ জিনিসটা ধর্মবিশ্বাসের মতই অন্ধ-কালা-বোবা । একেবারেই প্রতিবন্ধী ।
যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে কোন জিনিসকে বিচার করার মত সহনশীলতা বা নমনীয়তা নেই একেবারেই ।
নইলে, যে সমাজে ডাস্টবিনে কুকুর মা পাহারা দেয় মানবশিশুকে , আস্তাকুড়ে ঠাঁই হয় কন্যাভ্রূনের ; সেখানে একজন দায়িত্বশীল সক্ষম মা -কে তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে আদালতে চক্কর কাটতে হয় ফী-বছর ?
দেহ যখন নারীর , জরায়ু -গর্ভাশয়ও যখন মায়ের ; তখন সেই মা-ই সিদ্ধান্ত নেবে তার সন্তান পৃথিবীতে আসবে কিনা । যদি আসে তাহলে তার শরীরের পুষ্টিরস দিয়ে যে ভ্রূনকে তিলেতিলে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ তিনি দিয়েছেন সেই প্রাণটির অভিভাবক তথা সর্বময় ঈশ্বর সব হবেন সেই মা । আর কেউ না । কোনো যুক্তিতেই না ।
পুরুষের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় বীর্য ঢেলে । এর পরে কি হল, কি হবে তা নিয়ে মোটেও সে মাথা ঘামায় না । তাহলে, সেই বীর্য থেকে 'মানুষ' হল না 'শুয়োর' হল তা নিয়ে পিতৃত্বের ন্যাকামি থাকার প্রশ্নই ওঠে না ।
সুতরাং নারীরা কোনোভাবেই সন্তানকে বলতে বাধ্য নন, কে তার বাবা ।
প্রশ্ন উঠবেই, বিজ্ঞানসম্মতভাবে যদি গর্ভাশয় ভাড়া দেওয়া একটি সারোগেট মাদার তার পরিচয় গোপন রাখতে পারেন আজীবন , তাহলে বীর্য ভাড়া দেওয়া একটি পুরুষ কেন 'বাবার ' পরিচয় পাবে ?
সারোগেট গরীব মা হয়তো টাকার বিনিময়ে কাজটি করেন , কিন্তু পুরুষ তো টাকার চেয়েও বড় জিনিসের বিনিময়ে লিঙ্গসুখের কাণ্ডটি ঘটায় -- নারীর মাংস-হৃদয় ভক্ষন , মানসম্মানের বলাৎকার দ্বারা।
ডিম্বানুকে নিষীক্ত করতে একটি ফার্টাইল শুক্রানু দরকার যা যে কোন লাইসেন্সপ্রাপ্ত 'স্পার্ম ব্যাঙ্ক' থেকে পাওয়া যায় । তাহলে এক্ষেত্রে সেই ভাড়ার শুক্রানুর মালিককে 'বাবা' বলা যায় কি ?
প্রশ্ন ওঠে ।
প্রশ্ন আরো ওঠে , এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পাশপোর্ট বানাতে হলে যেখানে বাবার নামধাম-ঠিকুজির দরকার পড়ে না , তাহলে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বাচ্চার গার্জিয়ান হিসেবে মায়ের নাম কেন মান্যতা পাবে না ?
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় , এই সকল প্রশ্নের মুখে সপাট উত্তর জুগিয়েছে ।
তবু...
তবু...
আশঙ্কা থেকেই যায় , উচ্চ আদালতের রায় আমাদের এই প্রতিবন্ধী সমাজের 'চুঁইয়ে পড়া' নীতি ফলো করে নিম্নস্তরেও পৌছাবে তো ? লোকাল থানা বা স্থানীয় প্রশাসন অবধি লাগু হবে তো সত্যি ? নাকি এখনো ডাস্টবিনে পিঁপড়ে ছিড়ে খাবে কোনো শিশুকে ? অথবা দত্তক আইনের মারপাচে হন্যে হবে অন্য এক যোগ্য মা ? অথবা স্কুল ফিরিয়ে দেবে 'বাবার নাম জেনে তবে আসুন' এই বলে ?
আমরা আশায় বাঁচতে চাই । তাই ভাবতে চাই এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও আখেরে শিক্ষিত স্বনির্ভর মায়েরা নিশ্চয় ভাষা পাবেন তাদের অভিভাবকত্বের প্রশ্নে ।
দেশে এখন 'বেটি বাঁচাও , বেটি পড়াও ' নামে আন্দোলন শুরু হয়েছে সরকারিভাবেই । ভারতের বহু গ্রাম এখন মহিলা শুন্য । রাজস্থান-গুজরাটে কন্যাভ্রূন হত্যার কুফল হিসেবে সেখানকার সমাজ ভুগছে সোনার ছেলেদের বিয়ে -সংসার ইত্যাদি প্রশ্নে । কারণ ওই যে, পুং মালিকানা ফলাতে হলেও তো চাই এক নারী শরীর ।
তাদের নিজেদের কানেই একই প্রশ্ন বাজছে , বেটি নেহি বাঁচাওগে ... তো বহু ( বৌ ) ক্যায়সে পাওগে ?
উচ্চ আদালতের এই রায় হয়তো এই আন্দোলনকে এক অন্য দিশা দেবে , আশা রাখি ।
নারী শিক্ষিত হলে , স্বনির্ভর হলে পুরুষের অপদার্থতাকে লাথি মেরে নিজের একক মাতৃত্বের সংসার গোছাতে পারবে ।
গোছাতে গিয়ে বাধা এলে অন্তত শিক্ষিত মেয়েরা সমাজের লালচোখকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে নিজেদের বুদ্ধি যুক্তি দিয়ে সন্তানকে বুকে নিয়ে পথে তো নামতে পারবে , আর সাথি হিসেবে পাবে সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়কে , আইনের রূপ পেতে যার খুব দেরি হয়তো হবে না ।
এভাবেই ' পড়ে গা ইন্ডিয়া ... তব হি তো বড়ে গা ইন্ডিয়া ' -- আপ্ত বাক্য সফল হবে ।
কারণ, মনীষীরা যুগ যুগ ধরে বলে আসছেন, সেই দেশই প্রকৃত স্বাধীন ও শিক্ষিত... যে দেশের নারী জাতি স্বাধীন ও শিক্ষিত ।
দেশ ও সমাজের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায়ের মুকুটে আরো অনেক উজ্জ্বল পালক যুক্ত হোক , এই আশা নিশ্চয় খুব বেশি কিছু চাওয়া নয় ।
খুব ভালো হয়েছে লেখাটা ! তবে এই লেখা যদি কোনও পত্রিকায় পাঠানোর পরিকল্পনা থাকে তাহলে একটু পরিমার্জন বা হয়তো একটু এডিটের দরকার হবে ! কারণ সংবাদ পত্র গুলোর অনেক ধরণের ক্রনিক ব্যারাম আছে লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে! আর লেখাটারও 'একটু' 'সেপ'-এ আনার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়।
ReplyDelete