১৫ ই আগষ্ট ১৯৪৭ এ মধ্যরাতে যে দুটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করে, আমার দেশ তারই মধ্যে একটা । খুব ছোটবেলায় দেশ মানে বুঝতাম ‘খুব-কঠিন-আঁকতে এমন’ একটা মানচিত্র । বড়বেলায় বুঝলাম মানচিত্র নয় - মানুষ ,জীবজন্তু, আলো ,হাওয়া ,মাটি আর আকাশ সব মিলিয়েই স্বদেশ । কিন্তু গোলমাল করল ‘আকাশ’ শব্দটা । সব স্বাধীন দেশের একটা মৌলিক সীমানা থাকে – ভূগোল বইয়ে ওমুক দেশের সীমানা বর্ননা দাও –তে ঢের দেখেছি । আমার দেশেরও সীমানা আছে, যা টপকে এদিক ওদিক যেতে হলে সরকারি ছাড়পত্র লাগে । নদীর উদ্দাম স্রোতেও নাকি দেশের চালক বেড়া লাগিয়ে ‘জল দেব কিনা ভাবব’ বলতে পারে । কিন্তু আকাশের সীমানা ? পাখির অথবা ঘুড়ির ওড়া দেখতে গিয়ে আমার ভাবনা সেই যে ঘেঁটে গেল , আজও সরল হল না ।
১৫ আগষ্ট – তারিখটা বড্ড ঝলমলে । সোশাল মিডিয়া থেকে আনসোশাল জনতা সব্বাই তিরঙ্গা বাগিয়ে ‘কদম কদম বড়ায়ে যা...’ গায় । এইদিন সকাল হলেই মনে পড়ে আরিব্বাস, আমাদের স্বাধীনতা এসে গেছে, চল চল তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠ !
সেবারের স্বাধীনতা দিবসও একদম এরকম ছিল । ফেসবুকে ছবি পালটানো, এফ এমে দেশাত্মবোধক গান, আর স্কুলের বাচ্চাদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘দেশ রঙ্গিলা’ নাচ , সবশেষে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ । ‘...জয় হে’ সুর বেশ জোরালো ছিল অন্যদিনের প্রেয়ার লাইনের চেয়ে ।
কিন্তু স্বাধীনতার ৬৯ বছর পূর্তি নিয়ে জননেতার রক্তগরম বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ ক্লাস সেভেনের কুসুম কোরা যখন বিস্কুট খেতে খেতে দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল , আর জানতে পারলাম মিড-ডে-মিল বন্ধ থাকা ছুটির দিনে ওর ছোট্ট পেট কামড়াতে থাকে খুব – সেদিন আমার স্বাধীনতার স্বাদ নিমেষে পানসে হয়ে গেল ।
কিন্তু স্বাধীনতার ৬৯ বছর পূর্তি নিয়ে জননেতার রক্তগরম বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ ক্লাস সেভেনের কুসুম কোরা যখন বিস্কুট খেতে খেতে দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল , আর জানতে পারলাম মিড-ডে-মিল বন্ধ থাকা ছুটির দিনে ওর ছোট্ট পেট কামড়াতে থাকে খুব – সেদিন আমার স্বাধীনতার স্বাদ নিমেষে পানসে হয়ে গেল ।
অথবা যেদিন ক্লাস টেনের সোমা হাঁসদা দীর্ঘ দিন স্কুল কামাইয়ের পর হঠাৎ উপস্থিত হয়ে জানিয়ে দিল ও আর পড়বে না, বিয়ের ঠিক হয়েছে আর সে খুশি খুশি বিয়েটা করছে – সেদিন আমার পায়ের শেকলের তীব্র ঝনঝনানি গোপনে টের পেলাম ।
তবে সব দিন ছবিটা একরকম থাকে না ।
তবে সব দিন ছবিটা একরকম থাকে না ।
মাঝেমাঝে যখন অভি সাঁতরার মত ছেলের কথা শুনি ‘পড়তে খুব ইচ্ছা জাগে, তবে বাপের সাথে খাদানের কামেও তো যেতি হবেক । তাই তিন দিন স্কুলে আইসবক, বাকি দিন কামে যাবক । হবেক লাই, দিদিমুনি ?’- তখন ভরা শীতেও আমার স্বাধীনতা দিবস মিঠেকড়া রোদ্দুর হয়ে ছুঁয়ে যায় শিরাওঠা হাতের আঙুল ।
আবার যখন চিন্তামণি হেমব্রম স্কুলের ক্যারাটে ক্লাসেই শুধু ‘দারুণ কিছু দেখায়’ না , আত্মসম্মান বাঁচাতে শিস দেওয়া ছেলেগুলোর দিকেও মোক্ষম পাঞ্চ ছুঁড়ে দেয় – সেদিন স্পষ্ট বুঝি আমার ঘাড়ের পেছনটায় ঋজুতা প্রকট হয়েছে ।
আমার কুসুম , অভি, রতন বা চিন্তামণিরা ১৫ই আগষ্টের তাৎপর্য বোঝে না, ‘স্বাধীনতা’ শব্দের মানেও জানে না । ইতিহাসে নাম্বার তুলতে যা লাগে , সেটুকুই তারা মনে রাখতে পারে না । সোজা কথায় তারা বোঝে এই দিন একটা পতাকা তোলার সাথে সাথে এক প্যাকেট বিস্কুট মিলবে । মানে ১০ টায় কাজে যাওয়ার আগে ভরপেট না হোক, পেটভরা কিছু একটা খেতে মিলবে ।
আমার কুসুম , অভি, রতন বা চিন্তামণিরা ১৫ই আগষ্টের তাৎপর্য বোঝে না, ‘স্বাধীনতা’ শব্দের মানেও জানে না । ইতিহাসে নাম্বার তুলতে যা লাগে , সেটুকুই তারা মনে রাখতে পারে না । সোজা কথায় তারা বোঝে এই দিন একটা পতাকা তোলার সাথে সাথে এক প্যাকেট বিস্কুট মিলবে । মানে ১০ টায় কাজে যাওয়ার আগে ভরপেট না হোক, পেটভরা কিছু একটা খেতে মিলবে ।
যখন একদিকে ভরপেট পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে কলিমুদ্দিন মিয়াঁর পোয়াতি বৌ প্রসবের আগেই দম শেষ করে, তখন অন্যদিকে মাংসের জাত-ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রনেতারা ত্রিশূল আর তরোয়ালের রক্তচক্ষুর আস্ফালন দেখায় , তখন আমার সত্তরটি স্বাধীনতা দিবস দেখা বুড়ো দেশ লজ্জায় চোখ মোছে ।
ইংলিশ মাধ্যমের হুঙ্কারের চোটে অবৈতনিক বাংলা স্কুলগুলো যখন ছাত্রসংকটে ভুগছে, সেইসময় খারিজি মাদ্রাসাগুলোর সুবিধাবাদী অনুমোদনের নির্লজ্জ দাবী পেশ দেখে আমার সত্তুরে স্বদেশ গ্লানির দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান তোলা দেশেই যখন কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, সুজেট, জ্যোতি , অরুণাদের সম্মানহানী হয় দিনেদুপুরে, ন্যায়বিচার যখন রাজনৈতিক যুপকাষ্টে পড়ে হাঁসফাঁস করে , সোমা-রত্নাদের বাল্যবিবাহ হয়, সাড়ে তিন বছরের যোনীতে বিঁধে থাকে সাত খানা সুঁচ, ভিন জাতে বিয়ে করা অহল্যার মাথা কেটে থানায় আত্মসমর্পন করে ‘অনার কিলিং’-এর গর্বিত দাদা – তখন আমার যন্ত্রনাক্লীষ্ট ক্লান্ত স্বদেশ মনে মনে প্রাক ’৪৭ এর সংগ্রামী দিনগুলো মনে করে স্বান্তনা খোঁজে, কান্না লুকায় ।
সেই একই দেশ শিশুর মত ঝলমল করে হেসে ওঠে সাক্ষী-সিন্ধুর রুপোলী অলিম্পিক সাফল্যে , ‘ইসরো’র মুকুটে নতুন রঙিন পালকে ।
যখন আব্বাস, সাবির, আকবরদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে অর্জুন , প্রশান্ত, নবারুণ, মিলিরা ‘নির্মল বাংলা’ অথবা ‘স্বচ্ছ ভারত মিশনে’ ঝাড়ু-ন্যাতা হাতে হাত লাগায়, চারাগাছ পোঁতে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের গেটে সুন্দর করে আলপনা দেয় – আমার স্বাধীন স্বদেশের সাদা দাড়ি তখন তৃপ্তির অশ্রুতে ভিজে যায় ।
যখন আব্বাস, সাবির, আকবরদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে অর্জুন , প্রশান্ত, নবারুণ, মিলিরা ‘নির্মল বাংলা’ অথবা ‘স্বচ্ছ ভারত মিশনে’ ঝাড়ু-ন্যাতা হাতে হাত লাগায়, চারাগাছ পোঁতে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের গেটে সুন্দর করে আলপনা দেয় – আমার স্বাধীন স্বদেশের সাদা দাড়ি তখন তৃপ্তির অশ্রুতে ভিজে যায় ।
এই যে নিতান্ত আটপৌরে আমি, চাকরিরতা স্মার্ট ফোনে মুখ ডোবানো আমি , চেনা পথের ভীরু-বোকা নিত্যযাত্রী আমি, কারু সাতে পাঁচে না থাকা পরশ্রীকাতর আমি, খানিকটা পরোপকারী আর অনেকটা স্বার্থপর জিন রক্তের কণিকায় পুষে রাখা আমি , হ্যাঁ-কে হ্যাঁ আর না-কে না বলা আমি, অন্যায়গুলোকে মুখ বুজে সহ্য করা আমি, প্রতিবাদে চিৎকার করা আমি, ভাল-থাকার মুখোশে সমস্ত খারাপকে আপ্রাণ লুকাতে চাওয়া এই আমিই যখন দোকানীর দেওয়া প্লাস্টিককে তুমুল মাথা নেড়ে ‘না’ বলি , তার অবাক দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ফ্যাশানেব্যল পলিথিনকে হেলায় এড়িয়ে নিজের ছেঁড়া চটের ব্যাগে অথবা পুরোনো চামড়ার থলিতে জিনিস ভরি - জনমদুখিনী আমার সত্তুরে স্বাধীনতা তখন আলগোছে আমার কপালে চুমু খায় ।
এই আমিই যখন সব্জি বাজারে চড়া দাম নিয়ে ঝগড়া করি আবার মুদিখানার ভুল বিল দেখে দিব্যেন্দুদার কাছে ভুলে যাওয়া আটার দামটা তিতিবিরক্ত মেজাজেই দিতে যাই আর বড় ভালবেসে সে বলে ‘ আপনি বলেই এদ্দুর ফিরে এসে বাকি টাকা দিলেন দিদি, অন্য কেউ হলে...’ – তখন আমার ‘ডেভেলপিং ইণ্ডিয়া’ আদর করে কপালের বেয়ে আসা ঘাম আলতো হাতে মুছে দেয়।
বাসের প্রথম সীটে বসা চকমকে শাড়ি পরা আধুনিকা মা যখন ‘শ – শ’ করে জানলা দিয়েই পুত্র সন্তানকে হিসি করতে শেখায়, আর সেই বাসেরই শেষ সীটে পাঁচ বাড়ি কামিন খাটা বাসন্তী কুমারী মুড়ির প্যাকেট বাইরে না ফেলে মুঠোয় রাখে ডাস্টবিনে ফেলবে বলে – তখন সভ্যতার তুলাযন্ত্রে ‘শাইনিং ইণ্ডিয়া’ হীনতা আর স্বাধীনতার পাল্লা মাপে ।
যে বারো বছরের ছেলেটা ১৫ই আগষ্টের শুনশান দুপুরে বা ঝিরঝিরে বিকেলে অথবা ১৬ই আগষ্টের কাক ডাকা ভোরে পোলো গ্রাউণ্ডে অথবা রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে নেয় ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের তেরঙা, যাতে কেউ পা না দিয়ে ফেলে তাই ধুয়ে পরিষ্কার করে তুলে রাখে ‘মুক্তাঙ্গনে’র স্যাঁতস্যাঁতে কুলুঙ্গীতে আগামী বছর ট্রাফিক সিগন্যালে ওইগুলো বেচে ‘ফিফটিন আগষ্ট মানাবে’ বলে – বুড়ো স্বাধীনতা সে ছেলের গায়ে শীতের রাতে একটা নামহীন নকশিকাঁথা ঢেকে দেয় ।
ওই যে যারা ক্রিকেট খেলায়, মাংস খাওয়ায় , পাথর ছোঁড়ায়, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকায় , পতাকা জাপ্টে সেলফি তোলায়, ‘করতে হয় আর করতে নেই’-এর বুদ্ধিজীবিও তর্কবিতর্কে দেশপ্রেম খোঁজে ;
অথবা যারা সীমান্ত পারে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়, নেতানেত্রীর তুমুল তর্জন-গর্জনে, রাজনৈতিক ময়দানে সত্তরটা স্বাধীন বসন্ত ধরে লাগাতার এন্টারটেইনমেন্ট উপহার দেয় – তারা কি আমাদের কুসুম কোরা, অভি সাঁতরা , চিন্তামণি হেমব্রম, বাসন্তী কুমারী, দিব্যেন্দুদা অথবা ‘মুক্তাঙ্গনে’র বাচ্চাদের কথা জানে ?
রাফখাতার পাতা ভরে ওঠে এমন সব হিজিবিজি প্রশ্নমালায় ।
উত্তরগুলোই আজ অবধি থেকে গেছে অজানা ।
কে জানে আমার সিনিয়র সিটিজেন স্বাধীন দেশ আর কত 'বড় হলে' সঠিক উত্তরটা দিতে পারবে !
উত্তরগুলোই আজ অবধি থেকে গেছে অজানা ।
কে জানে আমার সিনিয়র সিটিজেন স্বাধীন দেশ আর কত 'বড় হলে' সঠিক উত্তরটা দিতে পারবে !